খালি চোখে আর কয়টা তারাই বা দেখা যায়। খুব পরিষ্কার অন্ধকার আকাশ হলে কয়েকটি তারকাস্তবক কিংবা সামান্য কিছু ডিপ স্কাই অবজেক্ট চোখে পড়তে পারে। কিন্তু আমাদের যুগ পাল্টেছে। আমরা এখন চাই অদেখা বস্তুসমূহের ছবি দেখতে, দেখতে চাই বহু দূর দূরান্তের আকাশের সুবিশাল চিত্র। এসবের জন্য তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের তরঙ্গ শনাক্তকারী যন্ত্র/ডিটেক্টর।
মহাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেতার তরঙ্গ, এক্স-রে, কসমিক রশ্মির মতো বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ। এসব তরঙ্গকে অ্যান্টেনার সাহায্যে ধারণ করে জানা যায় তরঙ্গ উৎসের অনেক তথ্য। বেতার তরঙ্গ বা রেডিও ওয়েভের উৎস কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বে কম নয়। আমরা বুঝতে না পারলে কি হবে! এগুলো রেডিও টেলিস্কোপে ঠিকই ধরা পড়ে। বেতার তরঙ্গের কম্পাংক কিন্তু অনেক বেশি রেঞ্জের হয়। মোটামুটি 3 কিলোহার্টজ থেকে 300 গিগাহার্টজ এর মাঝে থাকে বেতার তরঙ্গের কম্পাংক। এখন আমাদের যেসব রেডিও টেলিস্কোপ আছে তাদের বেশিরভাগই বেশি কম্পাংকের রেডিও তরঙ্গে কাজ করে। এই যেমন CARMA রেডিও অবজারভেটরিতে 75 গিগাহার্টজ এর বেশি কম্পাংকের তরঙ্গ নিয়ে কাজ করা হয়। VLA কিংবা ALMA তেও 50 গিগাহার্টজের উপরের কম্পাংক শনাক্ত করা হয়৷
যতগুলো রেডিও টেলিস্কোপ আছে পৃথিবীতে তার বেশিরভাগই এই বেশি কম্পাংক নিয়ে কাজ করে। খুব কম সংখ্যকই কম কম্পাংক শনাক্ত করে কাজ করে। এদের মাঝে LOFAR অন্যতম। LOFAR এর পূর্ণরূপ হলো Large Frequency Array। 250 মেগাহার্টজ তরঙ্গের কম তরঙ্গও শনাক্ত করতে সক্ষম LOFAR. আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো LOFAR কিন্তু এক জায়গায় স্থাপিত শুধুমাত্র একটি রেডিও টেলিস্কোপই নয়৷ এর রয়েছে বিভিন্ন দেশে ছড়ানো ছিটানো 52 টি স্টেশন৷ সব মিলিয়ে তরঙ্গ শনাক্ত করার জন্য অ্যান্টেনার সংখ্যা 20000 এর মতো। এই সব মিলিয়ে LOFAR এক অন্যরকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। 1000 কিলোমিটার এরও বেশি জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছে LOFAR এর এক বিস্তৃত নেটওয়ার্ক।
কম কম্পাংক এর বেতার তরঙ্গ নিয়ে কাজ করাটা কিন্তু অনেক দূরুহ ব্যাপার। এর কারণ হলো আমাদের পৃথিবীর আয়োনোস্ফেয়ার। আয়নোস্ফিয়ার হলো আমাদের বায়ুমন্ডলের একদম শেষাংশ। অতি কম কম্পাংকের আলো আয়োনোস্ফিয়ারে বাধা পেয়ে আবার মহাকাশেই ফিরে যায়। আর যারা আসে তারা আয়নোস্ফিয়ারের ভিতর দিয়ে বিকৃত হয়ে আসে। স্থির শান্ত জলাধারের পরিষ্কার পানি থাকলে জলাধারের তলদেশ কিন্তু পরিষ্কার দেখা যায়। কিন্তু যদি পানিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে তাহলে কিন্তু তলদেশ বিকৃতভাবে আমাদের চোখে ধরা দেবে। এরকম ঘটনাই ঘটে যখন কম্পাংকের পরিমাণ কমতে থাকে। এছাড়া LOFAR এতসব স্টেশন ব্যবহাএ করে শুধুমাত্র এসব বিকৃত তরঙ্গের তথ্য ঠিকমতো পাওয়ার জন্য। কম্পাংক কম মানে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি। বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যে আয়নোস্ফিয়ার এর প্রভাবও বেশি। তাই LOFAR এর কাজটা কিন্তু বেশ চ্যালেন্জিং।
2021 সালের 18 ফেব্রুয়ারি অ্যাস্ট্রোনমি এন্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স জার্নালে একটি ম্যাপ প্রকাশিত হয়। এই ম্যাপটি যেন তেন ম্যাপ না। ম্যাপটি হলো পঁচিশ হাজারের বেশি ব্লাকহোল সমৃদ্ধ এক ম্যাপ!
ব্লাকহোল তো দেখা যায় না, তাহলে এর ম্যাপ হলো কীভাবে?
ঐ যে বেতার তরঙ্গ আছে তো। মহাবিশ্বের অতি ঘন অঞ্চলগুলো থেকে যে রেডিও তরঙ্গগুলো আসে সেগুলোর কম্পাংক বেশিরভাগ সময় কম থকে। ঘন অঞ্চল বলতে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত ব্ল্যাকহোল চিন্তা করতে পারেন। তো, LOFAR এর কৃতিত্বটা এখানেই। সমগ্র আকাশের মাত্র 2% জায়গা থেকে রেডিও তরঙ্গ গুলো নিয়ে কাজ করা হয়েছে। আয়নোস্ফিয়ারের দরুন কম কম্পাংকের তরঙ্গগুলো বিকৃত হওয়া সত্ত্বেও প্রতি 4 সেকেন্ড অন্তর অন্তর সুপার কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে তরঙ্গগুলোকে ফিল্টার করা হয়েছে। প্রতিটা স্টেশনের ডাটা এক করে মিলাতে হয়েছে। সব মিলে LOFAR হয়ে উঠেছে এক ভার্চুয়াল টেলিস্কোপ! 256 ঘন্টার অবজারভেশনের পর তৈরি করা হয়েছে এক ম্যাপ। ম্যাপটি দেখুন নিচে। প্রতিটি সাদা বিন্দু একেকটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল।

চিত্রটি আসলে কী বোঝায় আমাদের?
এই চিত্র থেকে আমাদের মহাবিশ্ব যে কতটা বিশাল তার একটি আন্দাজ করা যায়। আকাশের মাত্র 2% জায়গা নিয়ে অবজারভেশনে 25000+ ব্ল্যাকহোল পাওয়া গেলো। বাকি 98% এ কি অবস্থা! এত এত গ্যালাক্সি, এত বিশাল আকারের ব্ল্যাকহোল, তার মাঝে আমরা, মানবজাতি কতটা ক্ষুদ্র তা সহজেই অনুমেয়। বিশালতার এই ক্ষুদ্র প্রান্তে বসে আমরা দৃষ্টি মেলে দিয়েছি মহাবিশ্বের দিকে। এই ধারা অব্যহত থাকলে আমরা বুঝবো এই মহাবিশ্বের অকল্পনীয় পরিধি!
সূত্র : নেচার
3 comments on “25000+ ব্ল্যাকহোলের ম্যাপ প্রকাশ”
জোস খবর বদ্দা। চলো, আমরা বাকি ৯৮% এর ছবি তুলি?
তুমি তোলো, আমি দেখি 🙂
সবে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ