লেখক : হাসান উজ-জামান শ্যামল
পিএইচডি ছাত্র, Cell and Molecular Biology University of Texas at Austin
মিউটেশন সম্পর্কে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, সেটা হচ্ছে এটা র্যান্ডম অথবা এলোমেলো। এই কথাটা কি সত্য নাকি মিথ্যা, সেটা নির্ভর করে র্যান্ডম কথাটার সংজ্ঞা আপনি কীভাবে দিচ্ছেন তার ওপর।
র্যান্ডম মানে বেকারণ
চলতি অর্থে র্যান্ডম কথাটার একটা সংজ্ঞা এরকম – একটা ঘটনা যার পেছনে আদৌ কোন কার্যকারণ নেই। মানে বেকারণ আরকি।
এভাবে যদি র্যান্ডমের সংজ্ঞা দেই, তাহলে বলতে হবে মিউটেশন কখনোই র্যান্ডম নয়। এটার কারণ প্রকৃতির কোনো কিছুই কার্যকারণ ছাড়া হয় না। একমাত্র কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগৎ এর একটা ব্যাতিক্রম হতে পারে, কিন্তু সেটা বাদ দিলে প্রত্যেকটা ঘটনাই প্রাকৃতিক নিয়মে হয় এবং এদের পেছনে কোন না কোন কার্যকারণ, অণু-পরমাণুর ঠোকাঠুকি থাকেই। মিউটেশন – অর্থাৎ ডিএনএর অক্ষরের মধ্যে যে পরিবর্তন – এক ধরণের রাসায়নিক বিক্রিয়া। রাসায়নিক বিক্রিয়ার পেছনে যে কার্যকারণ থাকে – পরমাণু-মূলকের আদান প্রদান, রাসায়নিক বন্ধনের ভাঙ্গাগড়া – এই ব্যাপারগুলো স্কুলের রসায়ন থেকেই আমরা জানি। মিউটেশনের বিক্রিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়, এবং র্যান্ডমের এই সংজ্ঞানুসারে এটা মোটেও র্যান্ডম কিছু নয়।
র্যান্ডম মানে ছক্কার দান
আরেকটা অর্থে মিউটেশনকে র্যান্ডম মনে করা যেতে পারে – ছক্কার গুটি, কয়েন টস বা তাসের দানের মত ব্যাপার যেরকম র্যান্ডম। এগুলোর পেছনেও কিন্তু কার্যকারণ থাকে। ছক্কার দান কত উঠল তা নির্ভর করে গুটিটা প্রথমে কীভাবে ধরা হয়েছিল, কত বেগে ছোঁড়া হয়েছিল, সেই সময় বাতাসের স্পিড কত ছিল, গ্র্যাভিটির মান কত ছিল ইত্যাদি আরো কয়েকটা বিষয়ের ওপর। একই কথা কয়েন টস বা তাসের দানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু এই কারণগুলো থাকা সত্ত্বেও আমরা ব্যাপারটাকে র্যান্ডমই বলি – কারণ এই ফ্যাক্টরগুলো এতই সূক্ষ্ম এবং মাপা এতই জটিল যে চলতি জীবনে এগুলো বিবেচনা করে আমরা ছক্কার দান প্রেডিক্ট করতে পারি না। এটা হচ্ছে তাহলে র্যান্ডমের আরেকটা সংজ্ঞা – কোন ঘটনার কার্যকারণ থাকলেও, বিভিন্ন জটিলতার জন্য সেটাকে প্রেডিক্ট করতে না পারা।
এই অর্থে কি তাহলে মিউটেশন জিনিসটা র্যান্ডম?
আসলে এই অর্থেও মিউটেশন জিনিসটা র্যান্ডম নয়। এর কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা মিউটেশন আগে থেকে প্রেডিক্ট করতে পারি। যেমন ধরুন, আপনারা হয়ত এইচআইভি ভাইরাসের কথা শুনে থাকবেন। এই ভাইরাসটার মিউটেশনের হার এতই দ্রুত যে আমরা আজ পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে কোন টিকা বানাতে পারিনি। এখানেই কিন্তু আমরা মিউটেশন নিয়ে একটা প্রেডিকশান দিয়ে দিলাম – অমুক ভাইরাসের মধ্যে মিউটেশনের হার বাকি জীবজগতের থেকে বেশি। এর চেয়ে আরো সহজ উদাহরণ আছে, যেমন অতিবেগুনী রশ্মির সংস্পর্শে আসলে বা ক্যান্সার হলে ডিএনতে মিউটেশনের হার বাড়ে। শুধু সেখানেই শেষ নয়। মিউটেশনের বিক্রিয়া কয়েক ধরণের, এর মধ্যে কোন ধরণের মিউটেশন হবার সম্ভাবনা বেশি বা কম – সেটাও আমরা মোটাদাগে প্রেডিক্ট করতে পারি। এছাড়াও ডিএনএর কোথায় মিউটেশন বেশি হতে পারে, কোথায় কম হতে পারে, এ ব্যাপারে আমাদের কিছু গম্যি আছে।
মানে কোষের প্রাণরসায়ন, চারপাশের পরিবেশের অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু জ্ঞান থাকলেই আমরা বলে দিতে পারি যে, কোষের ভেতরে মিউটেশন হবার সম্ভাবনা বেশি নাকি কম, বেশি হলে কোথায় বেশি, কোন ধরণের মিউটেশন বেশি হতে পারে, ইত্যাদি। কিন্তু এমনি চলতে ফিরতে ছক্কার গুটির ক্ষেত্রে এরকম কোন প্রেডিকশন সেটা আমরা দিতে পারি না (একটু জটিল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে অবশ্য সবই সম্ভব, কিন্তু আপাতত আমরা শুধু দৈনন্দিন জীবনের কথা বলছি)।
এক কথায়, ছক্কার গুটির সাথে মিউটেশনের র্যান্ডম হওয়ার খানিকটা মিল হয়ত আছে – অনেক ক্ষেত্রেই আমরা একদম নির্দিষ্ট করে বলে দিতে পারি না কখন কোন মিউটেশনটা হবে – কিন্তু দু’টোর মধ্যে অনেক অমিলও আছে। মূল পার্থক্যটা হল মিউটেশনের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আগে থেকে বলে দেওয়া যায়, যেটা ছক্কার গুটির ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।
মিউটেশন কোন অর্থে র্যান্ডম?
তাহলে দুটো অর্থের কোনটাতেই যদি মিউটেশন জিনিসটা র্যান্ডম না হয়, তাহলে মিউটেশন জিনিসটা আসলে কোন অর্থে র্যান্ডম? কারণ জীববিজ্ঞানীরাতো আসলেই “র্যান্ডম মিউটেশন” কথাটা ব্যবহার করেন। তারা কী মনে করে তাহলে এই কথাটা বলেন?
জীববিজ্ঞানীরা আসলে একটা বিশেষ অর্থে মিউটেশনকে র্যান্ডম বলেন। সেটা হল, মিউটেশন যখন হয় তখন সেটা জীবের উপকার-অপকারের কথা চিন্তা করে হয় না। আমরা ছক্কার গুটির উদাহরণে আরেকবার ফিরে যাই। মনে করেন, লুডো খেলার মধ্যে আপনি এমন একটা জায়গায় আছেন যেখানে ছয় উঠলে খুব ভালো হয়। কিন্তু দান ওঠার সময় তো আপনার ওপর দয়াপরবশ হয়ে ছক্কার গুটি এই ব্যাপারটা বিবেচনা করবে না।
মিউটেশনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেকটা এরকমই। একজন জীব হিসেবে আমার কীসে উপকার হবে, কী করলে আমি সন্তান-সন্ততি বেশি রেখে যেত পারব – সেই ব্যাপারটা বিবেচনা করে আসলে মিউটেশন হয় না। কোষের মধ্যে এমন কোনো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া নেই যার মাধ্যমে ডিএনএতে ঠিক সেই মিউটেশনই হয় যেগুলো তাৎক্ষনিক মুহুর্তে আমার “দরকার”। শুধু এই একটা অর্থেই মিউটেশন জিনিসটা র্যান্ডম।
কিন্তু র্যান্ডমের এই সংজ্ঞাটাতেও আরেকদফা প্যাঁচ আছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীব আসলেই তার মিউটেশনের উপর খানিকটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। সম্পূর্ণ নয়, খানিকটা। যেমন জীবাণুর ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার অনেক দেখা যায় – যখন সে একটা পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে থাকে, হতে পারে সেটা খাদ্যাভাব অথবা অতিবেগুনী রশ্মি – তখন সে তার মিউটেশনের হারটা বাড়িয়ে দেয়। মানে এক্ষেত্রে একটা জীবাণু তার মিউটেশনের হার, অর্থাৎ কত বেগে তার ডিএনএর মধ্যে পরিবর্তন আসবে, সেটা নিয়ন্ত্রন করতে পারে। এই বিষয়টাকে আমরা বলে থাকি ব্যাকটেরিয়ার SOS Response। এর ফলে কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার কিছু উপকার হয় – দ্রুত মিউটেশন করার ফলে কোষের মধ্যে এমন কিছু বৈচিত্র্য হয়ত দেখা যায়, যেটা এই বৈরী পরিবেশে তাকে টিকে থাকতে সাহায্য করে।
এর চেয়েও সহজ উদাহরণ হচ্ছে আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ প্রক্রিয়া। রোগজীবাণুর হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাদের দেহে যখন অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, রোগ প্রতিরক্ষার কোষগুলো আমাদের ডিএনএর একটা নির্দিষ্ট জায়গায় খুব দ্রুত – মানে স্বাভাবিকের প্রায় দশ লাখ গুণ বেশি বেগে – মিউটেশন করতে পারে। এই ব্যাপারটাকে আমরা বলে থাকি Somatic hypermutation। এই ব্যাপারটাও আমাদের জন্য খুব দরকার – ডিএনএতে এভাবে মিউটেশন হওয়ার ফলে আমরা বৈচিত্র্যময় অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারি, ফলে রোগজীবাণুকে চিনতে সুবিধে হয়।
এই উদাহরণগুলো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু এখান থেকে মোটাদাগে আমরা যে শিক্ষাটা পাই তা হল – কিছু ক্ষেত্রে জীব আসলেই তার উপকারের জন্য তার মিউটেশনের হার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কাজেই মিউটেশনের ওপর জীবের যে আদৌ কোন নিয়ন্ত্রণ নেই – এই কথাটার অল্প হলেও কিছু ব্যতিক্রম আছে।
ভাষা বিভ্রাট
আসলে মিউটেশনের র্যান্ডম হওয়া না-হওয়া হচ্ছে একটা উদাহরণ, যেখানে একটা শব্দের চলতি অর্থ এক, কিন্তু শাস্ত্রীয় অর্থ সম্পূর্ণ আরেক। এরকম আরেকটা উদাহরণ হল থিওরি। চলতি অর্থে থিওরি কথাটার অর্থ হল ধারণা বা আন্দাজ, কিন্তু বিজ্ঞানের প্রেক্ষিতে সায়েন্টিফিক থিওরি কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঠিক সেরকম চলতি অর্থে র্যান্ডম শব্দটাকে আমরা যেভাবে ব্যবহার করি, মিউটেশন আসলে সেই অর্থে র্যান্ডম না। এটা খুব একটা নির্দিষ্ট অর্থে র্যান্ডম, যে অর্থটা শুধু জীববিজ্ঞান জগতেই সীমাবদ্ধ।
এজন্য সম্প্রতি জীববিজ্ঞানী ড্যান গ্রাউর বলেছেন, মিউটেশন কথাটাকে “র্যান্ডম” না বলে বলা উচিত “ইনডিফরেন্ট”। ইনডিফরেন্ট মানে কেয়ার না করা বা পাত্তা না দেওয়া। আসলেই মিউটেশন হওয়ার সময় জীবের ভাল-খারাপের প্রতি সেরকম পাত্তা দেয় না। সে ইনডিফরেন্ট।
কিছু ব্যতিক্রম বাদে অবশ্য।