Skip to content

Tachyon

বাংলায় বিজ্ঞান গবেষণায় প্রথম উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম

ব্ল্যাকহোলের ছবি

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অবশেষে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা অতিদানবীয় ব্ল্যাকহোল স্যাজিটেরিয়াস এ* এর ছবি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। এই ছবির সাহায্যে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, মহাবিশ্বের অধিকাংশ গ্যালাক্সির কেন্দ্রেই একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল বাস করে। এই ছবিটি একই সাথে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ বহন করে। ইভেন্ট হোরাইজন টেলিস্কোপের ৩০০ -এর অধিক গবেষকদের একটি দলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই ছবিটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে ২০২২ সালের ১২ মে।

বিজ্ঞানীদের ধারণা মতে, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল রয়েছে। যাকে স্যাজিটেরিয়াস এ* বা সংক্ষেপে একে SGR A* (উচ্চারণ স্যাজ এ স্টার) ডাকা হয়। ব্লাকহোলটির আশেপাশের বস্তু তীব্র মহাকর্ষ ক্ষেত্রের প্রভাবে একে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। ব্ল্যাকহোলকে কোনোভাবেই দেখা সম্ভব না। তবে এর আশেপাশে থাকা নক্ষত্রগুলো একে কেন্দ্র করে ঘোরে। তাই বিজ্ঞানীরা যখন দেখলেন আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় অঞ্চলকে ঘীরে আমাদের গ্যালাক্সির তারারা ঘুরছে, সেখান থেকে তারা ধারণা করে নিলেন এখানে একটি দৈত্যাকৃতির ব্ল্যাকহোল রয়েছে। তারাগুলো কয়দিন পরপর নিজ কক্ষপথ একবার প্রদক্ষিণ করে আসে সেই সময়ের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, স্যাজিটেরিয়াস এ* এর ভর আমাদের সূর্যের থেকে ৪০ লক্ষ গুণ অধিক ভরবিশিষ্ট।

ব্ল্যাকহোল এমন একটি রহস্যময় বস্তু যার নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের মধ্যে আলোর কণার মতো গতিশীল কণাও ঢুকলে আর বের হতে পারে না। আলোর কণা বের হতে পারে না বলে ব্ল্যাকহোলকে আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু ব্ল্যাকহোলের বাইরের দিকে অ্যাক্রিশন ডিস্ক নামে একটা অঞ্চল আছে। এই অ্যাক্রিশন ডিস্কে প্রচুর পরিমাণে মহাজাগতিক ধূলিকণা থাকে। ব্ল্যাকহোলের আকর্ষণে এরা প্রচন্ড গতিতে ব্ল্যাকহোলের চারপাশে ঘুরতে থাকে। এসকল কণার গতি অনেক বেশি হওয়ায় এরা নিজেদের মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষেও লিপ্ত হয়। সংঘর্ষের সময় প্রচন্ড তাপ উৎপন্ন হয়। এই তাপ রেডিয়ো সিগন্যাল ও এক্স-রে সিগন্যাল হিসেবে অ্যাক্রেশন ডিস্ক থেকে নির্গত হয়।

স্যাজিটেরিয়াস এ* থেকে ২৭০০০ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে আমাদের পৃথিবী। পৃথিবীতে বসে আমরা যদি এত দূরের একটি বস্তুর স্পষ্ট ছবি তুলতে চাই, তাহলে আমাদের লাগবে অনেক বড়ো আর অত্যাধুনিক মানের একটি ক্যামেরা। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য এই ক্যামেরাটি হচ্ছে রেডিয়ো টেলিস্কোপ। অ্যাক্রেশন ডিস্ক থেকে যে রেডিও সিগন্যাল বের হচ্ছে সেই সিগন্যাল মহাকাশের চারিপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে কিছু সিগন্যাল পৃথিবীতেও আসে। পৃথিবীতে যেসব রেডিয়ো সিগন্যাল আসছে, সেসব সিগন্যাল পৃথিবীতে বসানো রেডিয়ো টেলিস্কোপগুলো ডিটেক্ট করতে পারে। এই সিগন্যালগুলো পরবর্তীতে রেডিয়ো টেলিস্কোপগুলো রেকর্ড ও বিশ্লেষণ করে দ্বি-মাত্রিক ছবিতে পরিণত করে।

ব্ল্যাকহোলের আক্রেশন ডিস্ক থেকে আসা রেডিয়ো সিগন্যাল বিশ্লেষণ করে দ্বি-মাত্রিক চিত্র তৈরি করেন বিজ্ঞানীরা।

স্যাজিটেরিয়াস এ* ব্ল্যাকহোলের ছবি তোলার ক্ষেত্রে একটি চ্যালেঞ্জ ছিল টেলিস্কোপের সাইজ নিয়ে। এত দূরের একটি ব্ল্যাকহোলের ছবি তোলার ক্ষেত্রে আমাদের প্রয়োজন পৃথিবীর সমান একটি টেলিস্কোপের। কিন্তু পৃথিবীর সমান একটি টেলিস্কোপ তো আর বানানো সম্ভব না। তাহলে কী করার? এর জন্য বিজ্ঞানীরা একটি চমকপ্রদ পদ্ধতি ব্যবহার করলেন।

রেডিয়ো টেলিস্কোপ তার পরাবৃত্তাকার ডিশের সাহায্যে রেডিয়ো সিগন্যালগুলোকে কালেক্ট করে। এটিকে অনেকটা বালতিতে পানি সংরক্ষণ করে রাখার মতো। বালতি যত বড়ো হবে, তত বেশি পানি রাখা যাবে। একইভাবে রেডিয়ো টেলিস্কোপের ডিশ যত বড়ো হবে, একক সময়ে তত বেশি সিগন্যাল কালেক্ট করতে পারবে। কিন্তু যদি পৃথিবীর সমান বালতি না বানানো যায় তাহলে? তাহলে একটা কাজ করা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলো ছোটো ছোটো বালতি রেখে দেওয়া যায়। পরে সেই ছোটো ছোটো বালতি থেকে পানি নিয়ে একটি বড়ো বালতিতে ঢেলে নিলেও কিন্তু কাজ হয়ে যাবে, পৃথিবীর সব জায়গা থেকে পানি নেওয়াটা কিন্তু হবে। একই কাজ বিজ্ঞানীরা রেডিয়ো টেলিস্কোপের ক্ষেত্রে করলেন। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের আটটি রেডিয়ো টেলিস্কোপকে রেডিয়ো সিগন্যাল সংগ্রহের কাজে লাগালেন। সেখান থেকে প্রতিটি আলাদা আলাদা করে রেডিয়ো সিগন্যাল নেওয়া হলো। পরে সব সিগন্যাল একত্র করে একটি ছবি তৈরী করা হলো। এই আটটি রেডিয়ো টেলিস্কোপকে একত্রে বলা হয় ইভেন্ট হোরাইজন টেলিস্কোপ। আর অনেকগুলো টেলিস্কোপকে এক করে এমন একটি টেলিস্কোপের মতো কাজ করানোর পদ্ধতিকে বলা হয় রেডিয়ো ইন্টারফেরোমেট্রি।

পৃথিবীর আটটি রেডিয়ো মানমন্দির এক সাথে মিলে তৈরি করে ভেরি লং বেইজলাইন ইন্টারফেরোমিটার। এটি দিয়েই দুইটি ব্ল্যাকহোলের ছবি তোলা হয়েছে।

এর আগেও ২০১৯ সালে বিজ্ঞানীরা মেসিয়ার ৮৭ নামক গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা দৈত্যাকার সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের ছবি আমাদের সম্মুখে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। মেসিয়ার ৮৭ গ্যালাক্সি আমাদের গ্যালাক্সি থেকেও হাজারগুণে বড়ো। এর আকার বড়ো হওয়ায় এর চারপাশের মহাজাগতিক ধুলিকণাও সময় নিয়ে একে প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু স্যাজাটেরিয়াস এ* এর আকার তুলনামূলক অনেক ছোটো। ফলে মহাজাগতিক ধূলিকণাগুলো কয়েক মিনিটের মধ্যেই ব্ল্যাকহোলকে কেন্দ্র করে ঘুরে আবার আগের জায়গায় চলে আসে। তাই এখানে সময় স্বল্পতার কারণে সিগন্যাল নেওয়াটা কষ্টসাধ্য। এটির ধুলিকণাগুলো খুব দ্রুত আগের অবস্থানে ফিরে আসতে পারে বলে, আগের ব্ল্যাকহোলটির ছবির চেয়ে এই ব্ল্যাকহোলটির ছবিতে রিং-টি অধিক স্পষ্ট। একই সাথে এতে তিনটি উজ্জ্বল স্পট দেখা যাচ্ছে, যেখানে আগের ছবিতে কেবল একটি স্পটই দেখা যাচ্ছিল।

স্যাজিটেরিয়াস এ* এর রিং-এর ছবির ব্যাপারে ইভেন্ট হোরাইজন টেলিস্কোপের প্রজেক্ট সায়েন্টিস্ট Geoffrey Bower বলেন, “এই রিংটির আকার আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভির সাথে এতটাই খাপ খেয়ে গেছে যে এটি দেখে আমরা অনেক আশ্চর্যান্বিত হয়ে গিয়েছিলাম।”

ব্ল্যাকহোলের ছবি তোলার অ্যালগরিদম, যন্ত্রপাতি ও নানা কলাকৌশল দিনদিন আরো উন্নত হচ্ছে। এই ছবি তোলার মাধ্যমে আমরা বারবার আইনস্টাইনের রিলেটিভিটিকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলতে পারছি একই সাথে ব্ল্যাকহোলের ব্যাপারে জানতে পারছি নিত্য নতুন তথ্য।

তথ্যসূত্র

  1. মেসিয়ার ৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা ব্ল্যাকহোলের ছবির ব্যাপারে জানতে দেখুন Telescope, E. H. (2019). Astronomers capture first image of a black hole. https://eventhorizontelescope.org/press-release-april-10-2019-astronomers-capture-first-image-black-hole
  2. Telescope, E.H. (2022). Astronomers Reveal First Image of the Black Hole at the Heart of Our Galaxy. https://eventhorizontelescope.org/blog/astronomers-reveal-first-image-black-hole-heart-our-galaxy

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।