ঘুম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা দিনের এক-তৃতীয়াংশ সময় ঘুমিয়েই কাটাই। সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ ও মানসম্পন্ন ঘুম খাদ্য বা পানির মতই অপরিহার্য। ঘুম আমাদের মস্তিষ্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে, দ্রুত উদ্দীপনায় সারা দিতে ও মনোযোগ ধরে রাখতেও সাহায্য করে। সাম্প্রতিক অনুসন্ধান হতে জানা যায়, ঘুমের সময় আলঝেইমার রোগের সাথে সম্পর্কিত কিছু ক্ষতিকর প্রোটিন সাধারণের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে মস্তিষ্ক থেকে অপসারিত হয়। এছাড়াও ঘুম শরীরের প্রায় সব ধরণের টিস্যু এবং সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। গবেষণায় দেখা যায় ঘুমের দীর্ঘস্থায়ী অভাব, বা নিম্নমানের ঘুম, উচ্চ রক্তচাপ, কার্ডিওভাসকুলার রোগ, ডায়াবেটিস, বিষণ্ণতা এবং স্থুলতার মতো স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। তাই প্রতেকেরই পর্যাপ্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত ঘুম দরকার।
ঘুমের অ্যানাটমি

হাইপোথ্যালামাস নামে মস্তিষ্কের গভীরের একটি অংশ আছে, যা মূলত স্নায়ু কোষ গুচ্ছ দ্বারা গঠিত। এটি আমাদের ঘুম এবং জাগরণের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এই হাইপোথ্যালামাসের মধ্যে আরও রয়েছে হাজার হাজার কোষের সমন্বয় গঠিত সুপারকিয়াসমেটিক নিউক্লিয়াস (suprachiasmatic nucleus-SCN)- যা চোখ থেকে সরাসরি আলোর এক্সপোজার গ্রহন করে মস্তিষ্ককে জানান দেয়। এবং এর ওপর ভিত্তি করেই মস্তিষ্ক আমাদের ঘুমের আচরণগত ছন্দ নিয়ন্ত্রণ করে। আচরণগত ছন্দ বলতে বোঝাচ্ছি আমরা কখন ঘুমিয়ে পরবো আর কখন জেগে উঠবো। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্মার্টফোনের নীল আলোও সরাসরি আমাদের মস্তিষ্কের SCN-কে প্রভাবিত করে। এতে আমাদের ঘুমের ছন্দে বিঘ্ন ঘটে। এই SCN কে আবার মস্তিষ্কের “মাস্টার ক্লক”-ও বলা হয় কারন এটি আলোর সংকেত গ্রহণ করে এবং এই সংকেত অনুযায়ী সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমের মাধ্যমে পাইনাল গ্রন্থিকে মেলাটোনিন নামক হরমোন নিঃসরণের জন্য নির্দেশ দেয়। মেলাটোনিনের প্রধান কাজ হলো আমাদের শরীরের ঘুম-জাগরণ চক্র (Sleep-Wake Cycle) নিয়ন্ত্রণ করা। যখন অন্ধকার হয়, তখন SCN, পাইনাল গ্রন্থিকে মেলাটোনিন নিঃসরণ করার জন্য উৎসাহিত করে যা আমাদের ঘুম পারিয়ে দেয়।
মস্তিষ্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ব্রেনস্টেম যা মিডব্রেইন, পন্স ও মেডুলা অবলংগাটা এর সমন্বয়ে গঠিত। এটি আমাদের মস্তিষ্ক থেকে নির্দেশাবলী পেশীগুলোতে পাঠায় এবং শরীর থেকে সংবেদনশীল তথ্য মস্তিষ্কে নিয়ে যায়। হাইপোথ্যালামাস এবং ব্রেইনস্টেমের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু কোষ রয়েছে যা GABA (Gamma-aminobutyric acid) নামক রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে। এ রাসায়নিক পদার্থ আমাদের হাইপোথ্যালামাস ও এই ব্রেনস্টেমের কার্যকলাপকে হ্রাস করে । ফলে ব্রেনস্টেম (বিশেষ করে পনস এবং মেডুলা) আমাদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়ার জন্য প্রয়োজনীয় পেশীগুলোকে শিথিল করার সংকেত পাঠায়। তাই ঘুমের সময় আমাদের শরীর প্রায় অবস অবস্থায় থাকে। এ অবস্তাকে অ্যাটোনিয়া বলা হয়।
মস্তিষ্কের থ্যালামাস নামক আরেকটি অংশ ইন্দ্রিয় থেকে মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্সে তথ্য পাঠায় এবং সেরিব্রাল কর্টেক্স থেকে তথ্য গ্রহণ করে। ঘুমের বেশিরভাগ পর্যায়েই থ্যালামাস শান্ত থাকে, ফলে আমরা বাইরের জগত থেকে ইন্দ্রিয় দ্বারা কোনো উদ্দীপনা অনুভব করি না। কিন্তু REM sleep-র সময়, থ্যালামাস সক্রিয় থাকে এবং এটি মস্তিষ্কের কর্টেক্সে ছবি, শব্দ এবং অন্যান্য উদ্দীপনা প্রেরণ করে যা আমরা মূলত স্বপ্ন হিসেবে দেখে থাকি।
আমরা কখন জেগে থাকব এবং কখন ঘুমিয়ে থাকব তা নিয়ন্ত্রণ করে Circadian rhythm এবং Homeostasis নামক দুটি জৈবিক প্রক্রিয়া। প্রতিদিন জাগ্রত হওয়া থেকে শুরু করে শরীরের তাপমাত্রা, বিপাক এবং হরমোন নিঃসরণ পর্যন্ত বিভিন্ন কাজ Circadian rhythm দ্বারা পরিচালিত হয়। সহজ ভাবে বললে, Circadian rhythm হলো দেহের একটি অভ্যন্তরীণ জৈব ঘড়ি, যা ২৪ ঘণ্টার একটি চক্রে শরীরের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই ঘড়িটি প্রধানত মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে অবস্থিত Suprachiasmatic Nucleus (SCN) -এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এটি আমাদের নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে এবং স্বাভাবিকভাবেই জেগে উঠতে সহায়তা করে।
অন্যদিকে, Homeostasis প্রতিদিন আমাদের ঘুমের চাহিদা ট্র্যাক করে এবং সে অনুযায়ী ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে। যখন আমরা দীর্ঘ সময় ধরে জেগে থাকি, তখন মস্তিষ্কের রাসায়নিক পরিবর্তন যেমন Adenosin, জমা হতে শুরু করে, যা আমাদের ক্লান্তিকে বাড়ায় দিয়ে ঘুমের প্রবণতা সৃষ্টি করে।
আলোর প্রভাব: আলো আমাদের Circadian rhythm-এ গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে, নীল আলো (যা স্মার্টফোন, ল্যাপটপ এবং অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিন থেকে নিঃসৃত হয়) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই নীল আলো আমাদের মস্তিষ্কে মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণকে দমন করে। আগেই জেনেছি মেলাটোনিনের নিঃসরণ আমাদের ঘুমকে উদ্দীপিত করে। তাই মেলাটোনিনের নিঃসরণ দমন হলে আমাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে।
রাতের বেলার কৃত্রিম বা অতিরিক্ত আলো আমাদের ঘুমের সময়সূচিতে মারাত্মক বিলম্ব ঘটায়। যেহেতু এই সময়ে মেলাটোনিনের স্বাভাবিক নিঃসরণ শুরু হওয়ার কথা, আলোর উপস্থিতি সেই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে, ফলে ঘুম আসতে দেরি হয়।
এই আলোর প্রভাবকে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য ‘ফেজ রেসপন্স কার্ভ’ (Phase Response Curve – PRC) নামক একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা ব্যবহার করে। সকালে আলো আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়িকে এগিয়ে দেয় (Phase Advance), যার ফলে আমরা সকালে তাড়াতাড়ি জেগে উঠি। কিন্তু রাতের অতিরিক্ত আলো আমাদের শরীরের ঘড়িকে পেছিয়ে দেয় (Phase Delay), যার ফলে রাতে ঘুম আসতে দেরি হয়। অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর ঘুম নিশ্চিত করতে শান্ত ও অন্ধকার পরিবেশ হওয়া জরুরী।
ঘুমের বিভিন্ন পর্যায়
বিজ্ঞানীরা আমাদের ঘুমকে দুটি মৌলিক পর্যায় ভাগ করেন এগুলো হলো non-REM-sleep আর REM-sleep।
- Non-REM (Rapid Eye Movement) Sleep বা NREM: এটি আমাদের ঘুম শুরুর প্রাথমিক পর্যায়। NREM-sleep আমাদের শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসময় আমাদের শরীরের টিস্যু পুনর্গঠন হয়, কোষ মেরামত হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়। এই পর্যায়কে ৩টি উপপর্যায়ে ভাগ করা হয়।
- Stage 1 বা N1: ঘুমের N1 পর্যায় হলো NREM ঘুমের প্রথম ধাপ, যা সাধারণত হালকা ঘুম হিসেবে পরিচিত। এসময় আমদের হৃদস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাস, এবং চোখের নড়াচড়া কমতে থাকে এবং আমাদের পেশীগুলো ধীরে ধীরে শিথিল হয়। আমাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গ ধীর হতে থাকে। ঘুমের এই পর্যায়টি ১ থেকে ৭ মিনিটের মত স্থায়ী হয়। এ পর্যায় আমরা মাঝেমাঝে পেশির ছোটখাটো ঝাঁকুনি বা হিপনিক জার্ক (Hypnic jerks) অনুভব করি।
- Stage 2 বা N2: N2 পর্যায় হলো NREM ঘুমের দ্বিতীয় ধাপ এবং এটি ঘুমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই পর্যায়ে আমাদের শরীর আরও গভীর ঘুমের দিকে অগ্রসর হয়। NREM ঘুমের মোট সময়ের প্রায় ৫০% এই N2 পর্যায়ে ব্যয় হয়। এসময় আমাদের শরীরের হৃদস্পন্দন এবং শ্বাস ধীর, এবং পেশী আরও শিথিল হয়। শরীরের তাপমাত্রা কমে যায় এবং চোখের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। সুস্থ প্রাপ্তবয়স্করা সাধারণত N2 ঘুমের মধ্যে প্রায় অর্ধেক রাত কাটায়।
- Stage 3 বা N3: N3 পর্যায়, গভীর ঘুম বা স্লো-ওয়েভ স্লিপ (SWS) নামেও পরিচিত। এটি NREM ঘুমের সবচেয়ে গভীর এবং পুনরুদ্ধারমূলক ধাপ। অর্থাৎ এ পর্যায়ে আমাদের এটি আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ঘুমের সবচেয়ে গভীর স্তর, যেখানে জাগ্রত হওয়া সবচেয়ে কঠিন। এসময় আমাদের হৃদস্পন্দন এবং শ্বাস সবচেয়ে ধীরে হয় এবং শরীর বিভিন্ন বৃদ্ধি হরমোন নিঃসরণ করে, যা আমাদের দেহের ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু গুলোকে মেরামত করে। এ সময় মস্তিষ্কের তরঙ্গ ডেল্টা তরঙ্গ নামে পরিচিত, যা ধীর এবং উচ্চ-কম্পাঙ্কবিশিষ্ট হয়। মস্তিষ্ক এই পর্যায়ে স্মৃতিকে স্থায়ী করে এবং “ডিক্লারেটিভ মেমরি” (এক ধরনের দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি যা সচেতনভাবে মনে আনা যায় এবং তথ্য বা ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয়। একে “explicit memory” ও বলা হয়) এই পর্যায়ে প্রক্রিয়াকরণ হয়। সাধারণত আমরা এই পর্যায়ে রাতের প্রায় 10% থেকে 20% সময় কাটাই।
- REM (rapid eye movement) sleep: REM ঘুম (Rapid Eye Movement Sleep) ঘুমের চূড়ান্ত ধাপ এবং এটি পুরো ঘুমচক্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ধাপে মস্তিষ্ক অত্যন্ত সক্রিয় থাকে এবং আমরা বেশিরভাগ স্বপ্ন এই ধাপেই দেখে থাকি। ঘুমের এ পর্যায়ে আমাদের চোখের মণি উল্লেখযোগ্য ভাবে নাড়াচাড়া করতে থাকে তাই এই পর্যায়ের নাম “Rapid Eye Movement”, সংক্ষেপে REM। REM-sleep এর সময় আমাদের শরীরের পেশিগুলো কার্যত প্যারালাইজড (অচল) অবস্থায় থাকে, যাতে স্বপ্ন দেখা অবস্থায় শরীর নড়াচড়া না করে, একে REM অ্যাটোনিয়া বলা হয়। সঠিক ভাবে REM অ্যাটোনিয়া না হলে অর্থাৎ REM sleep এর সময় পেশি অচল না হলে তাকে REM sleep behavior disorder বা RBD বলে। এছাড়াও এ পর্যায়ে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত ও অনিয়মিত হয়ে ওঠে। শিশুরা REM ঘুমে তুলনামূলক বেশি সময় কাটায়, কারণ এটি মস্তিষ্কের বিকাশে জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। REM-sleep এ ঘাটতি দেখা দিলে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে পারে, আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদে মানসিক স্বাস্থ্য এবং শারীরিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

আমরা যখন ঘুমাই, তখন REM এবং NREM ঘুমের পর্যায়গুলোর চক্রাকারে চলে। সাধারণত, প্রতিটি চক্র গড়ে ৯০–১১০ মিনিট স্থায়ী হয় অর্থাৎ প্রতি রাতের (রাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমালে) আমরা সাধারণত ৪–৬ বার এই চক্রের মধ্য দিয়ে যাই। REM ঘুম সাধারণত প্রতি চক্রের শেষ দিকে আসে। প্রথমদিকের REM পর্যায় সাধারণত ঘুমিয়ে পড়ার প্রায় ৯০ মিনিট পর থেকে শুরু হয় এবং মাত্র ১০ মিনিটের মত স্থায়ী হয়। রাতের শেষের দিকের REM পর্বগুলো তুলনামূলক দীর্ঘ হয়, যা প্রায় ৩০-৬০ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া , সান ডিয়েগোর (University of California, San Diego) অধ্যাপক সারা মেডনিক (Sara Mednick) এবং তার সহকর্মীদের গবেষণায় দেখা গেছে, REM পর্যায়, মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে নতুন সংযোগ তৈরি করতে সাহায্য করে, যা সৃজনশীলতা এবং জটিল সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, REM ঘুমের পর মানুষ সৃজনশীল কাজে বেশি পারদর্শী হয়।
তথ্যসুত্র
- Sleep Foundation
- National Institute of Neurological Disorders and Stroke
- National Sleep Foundation (NSF)
- WikiPedia
লেখক
তৌফিক আহমেদ
একাদশ শ্রেণী, বি এ এফ শাহীন কলেজ তেজগাঁও